Assertion For Justice, Equality And Freedom.

Tuesday, April 22, 2014

'নারীর অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষায় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন’

 নারীরা সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় নারীরা, বিশেষ করে গ্রামীণ নারীরা, তাঁদের আয়ের অর্থ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। শহরের অনেক নারীরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। এই বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন অর্থনীতিবিদ রুশিদান ইসলাম রহমান। তিনি বর্তমানে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গবেষণা পরিচালক। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এ দেশের শ্রমবাজার, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করছেন। প্রথম আলোর উদ্যোগে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুচিত্রা সরকার। তাই নীচে তুলে ধরা হলোঃ

প্রথম আলো: নারীর অর্থনৈতিক অধিকার কথাটার মানে কী?

রুশিদান ইসলাম রহমান: নারীর অর্থনৈতিক অধিকারের মধ্যে প্রধান হচ্ছে মানসম্মত উপার্জনের কাজে নিয়োজিত হওয়ার সুযোগ; তাঁর নিজস্ব আয়, সঞ্চয় ও সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। সেই সঙ্গে পরিবারের অর্থনৈতিক বিষয়সমূহ, যেমন: সদস্যদের আয়-উপার্জনের কাজ, ব্যয় ও বিনিয়োগ ক্ষেত্রে মতামত দেওয়ার সুযোগও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে নারী-পুরুষ সবারই এসব অধিকার থাকতে হবে।

প্রথম আলো: বাংলাদেশে এই অধিকার কি সুনিশ্চিত হয়েছে?

রুশিদান ইসলাম রহমান: পুরোপুরি সুনিশ্চিত না হলেও কিছুটা তো অগ্রগতি হয়েছে। যেমন উপার্জনের কাজে নারীর নিয়োগের হার বাড়ছে। বর্তমানে এটা ৩৬ শতাংশ, যা আগে ছিল ২৯ শতাংশ। ১৯৯০-এর দশকে ছিল এর অর্ধেক।

প্রথম আলো: নারীর নিজস্ব আয়ে তাঁর অধিকার নেই কেন? কোন মানসিকতা থেকে পুরুষ নারীর আয়ে হস্তক্ষেপ করে?

রুশিদান ইসলাম রহমান: পরিবারের পুরুষ সদস্যরা যে নারী সদস্যদের বঞ্চিত করে সব আয় নিজের হাতে নিচ্ছে বা নিতে চায়, সেটা তো অবশ্যই আমাদের দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও সমাজমানসের ফল। সেই সঙ্গে অবশ্য কর্মনিয়োজনের ধরনটিরও প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে, সেদিকেই প্রথম দৃষ্টি দিই। এ দেশে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ বা কর্মনিয়োগের হার বাড়লেও আসলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারী অংশগ্রহণ করছে পরিবারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে। সেখানে পুরুষই উদ্যোক্তা, কারণ তাঁরাই সম্পদ ও বিনিয়োগের মালিক। আর বিনিয়োগযোগ্য সম্পদ বা মূলধনের মালিকানা যে পুরুষের হাতে তার পেছনে আমাদের পুরো সমাজব্যবস্থা ও মানসিকতার ভূমিকা রয়েছে যুগ যুগ ধরে। 

আর এসব পারিবারিক উদ্যোগে, তা সেটা কৃষিকাজ হোক বা পশুপালন, ক্ষুদ্র শিল্পই হোক, সেখানে ক্রয়-বিক্রয়ের কাজটি চলে পুরুষের হাত দিয়ে। কাজেই নারী যে শ্রমঘণ্টা এই কাজে দিচ্ছে সে অনুপাতে অর্থ তাঁর হাতে আসছে না। এমনকি নারী সব সময় জানতেও পারেন না এই উদ্যোগ থেকে কত আয় হচ্ছে, তা কীভাবে ব্যয় হচ্ছে বা বিনিয়োগ হচ্ছে। অন্যদিকে যখন নারী শ্রমিক মজুরি বা বেতনের কাজ করেন, সেখানেও তাঁর আয়ের ওপর অধিকার, ব্যয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত নয়। পুরুষ সদস্যরা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সেটার ওপর কর্তৃত্ব করেন। এখানে মানসিকতার বিষয়টি তো আছেই। কিন্তু সঙ্গে আছে আনুষঙ্গিক কিছু দিক।

যেমন যে নারীর ১৬-১৭ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে এবং স্বামী বা তাঁর পরিবারের নির্দেশে কোনো পোশাক কারখানায় কাজ নিয়েছে তিনি তো বাধ্য হবেনই বেতনের টাকাটা ওই পরিবারকে দিতে। নারীদের কম বয়সে বিয়ে হওয়াটা এখনো চলছে, এমনকি বিয়ের গড় বয়স কমছে। তারপর আছে পারিবারিক সহিংসতার ভীতি। বেতনের টাকা স্বামী বা শাশুড়ির হাতে তুলে না দিলে তাঁদের নির্যাতনের শিকার হতে হবে।

পরোক্ষভাবেও নারীর আয়ে তাঁর পুরো অধিকার থাকে না। যেমন উপার্জনরত স্বামী যদি তাঁর আয় সন্তানদের জন্য ব্যয় না করেন তাহলে তাঁর স্ত্রী বাধ্য হন নিজের আয় সন্তানদের জন্য ব্যয় করতে। এ ছাড়া পুরুষেরা পছন্দমতো উপার্জনকাজ না পেলে স্ত্রীর আয়ের ওপর নির্ভর করেন। অনেকে আবার মজুরিকাজে নিয়মিত যান না, স্ত্রীর উপার্জনের অংশ নিয়ে নানা বিনোদনে সময় ব্যয় করেন। এটা শুধু যে স্ত্রীর আয়ের বিষয়ে ঘটছে তা নয়। স্ত্রী যখন ক্ষুদ্রঋণ নিচ্ছে সেখানেও স্বামী এভাবে ঋণের অর্থ ব্যয় করছেন। অথচ কিস্তি পরিশোধের দায় বহন করছেন স্ত্রী।

প্রথম আলো: এর ফলে কি সামাজিকভাবে নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন? নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে এটা কি কোনো বাধার সৃষ্টি করছে?

রুশিদান ইসলাম রহমান: এটা একেবারেই পরিষ্কার যে এই পরিস্থিতি নারীর সার্বিক ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক অধিকার অর্জনের পথে একটি বিশাল অন্তরায়। এতে করে ভবিষ্যতে নারীর কর্মনিয়োজন কমে যেতে পারে উৎসাহের অভাবে।

প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন সার্বিকভাবে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের দরকার আছে? কী ধরনের উদ্যোগ নারীর জীবনের এই প্রতিবন্ধকতা দূর করবে বলে আপনি মনে করেন?

রুশিদান ইসলাম রহমান: এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই পরিস্থিতির পরিবর্তনের জন্য সম্পূর্ণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। শুধু স্বামীর ক্ষেত্রে নয়, স্বামী- পিতা-পরিবারের অন্যান্য পুরুষ এবং এমনকি অন্য নারীরা, যাঁরা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, তাঁদেরও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। কাজেই উপার্জনরত নারীর ভূমিকাটিকে আরও সম্মানের, আরও কার্যকর করার জন্য সচেতনতা দরকার, মানসিকতা তৈরি করা দরকার। এখানে সমাজ, রাষ্ট্র ও অন্যান্য ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও নতুন করে নারীর অধিকার শক্তিশালী করার মতো নিয়ম, কাঠামো ও সুবিধা তৈরি করতে হবে। যেমন একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে নারীর জন্য সঞ্চয়ী হিসাব খোলা সহজ করতে হবে। শহরের যে এলাকাতে নারী শ্রমিক বেশি, সেখানে বুথ খোলা যেতে পারে, স্বল্প বেতনের নারী কর্মীরা যেন বেতন পেয়েই তা ব্যাংকে রাখতে পারেন। ক্ষুদ্রঋণের পুরো দায়ভার যেন নারীর ওপর চেপে না বসে, সে জন্য ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ম-নীতি তৈরি করতে হবে যেন নারী ঋণগ্রহীতা ঋণ বিনিয়োগ করতে পারেন, উপার্জনের টাকার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেন।





তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বংলাদেশ।

 
Our Another Site : Right Way BD | Right Way BD FB Group | Right Way BD FB Page |