Assertion For Justice, Equality And Freedom.

Tuesday, April 22, 2014

নিজ আয়ের ওপর অধিকার নেই নারীর

‘বেতনডা পাইতে দেরি হইলেও, হের আইতে দেরি অয় না। বেতন পাইছি খবর পাইলে দ্যাশ থাইক্যা আইয়্যা পড়ে। ঘর ভাড়া আর খাওনের কিছু ট্যাকা দিয়া বাকি ট্যাকা লইয়্যা যায়। মন চাইলেও আমি কোনো খরচ করতে পারি না।’ কথাগুলো বলছিলেন তাসলিমা আক্তার। তিনি রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মোহাম্মদপুরের আদাবরে কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে একটি ঘরে ভাড়া থাকেন। বাড়িভাড়া, খাওয়া আর যাতায়াত বাবদ তিন হাজার টাকা ওর হাতে দিয়ে বাকি টাকা ওর স্বামী নিয়ে নেন।

ফাতেমার বিয়ে হয়েছে এক বছর আগে। বিয়ের আগে থেকেই তিনি পোশাক কারখানায় কাজ করে আসছেন। বিয়ের আগে তাঁর রোজগারের টাকায় বাবার সংসার চলত। বিয়ের পরও বাবাকে প্রতি মাসে দুই হাজার টাকা দিতেন। কিন্তু একদিন শাশুড়ি বাবাকে টাকা দিতে নিষেধ করলেন। অথচ টাকা না দিলে বাবা অনেক সমস্যায় পড়বেন। ফাতেমা ওভারটাইম শুরু করলেন লুকিয়ে লুকিয়ে। আর বাড়িতে শাশুড়িকে বললেন, কাজের চাপ বেশি। মাস শেষে বেতনের টাকাটা শাশুড়ির হাতে দিলেন। শাশুড়ি বললেন বাকি টাকা কই। ফাতেমা তো অবাক। খানিকটা ভয়ও পেলেন। তারপর শাশুড়ি পাশের ঘরে নিয়ে দেয়ালে খড়িমাটির কিছু দাগ দেখালেন। বললেন, ‘তুমি যত দিন দেরি কইর‌্যা আইস তত দিন দাগায়া রাখছি। জানি, তুমি ওভারটাইম করছ। ওই ট্যাকা দেও। কোনো টাকা বাপের বাড়িতে দেওয়া যাইব না।’ নীলক্ষেতে পিঠা বিক্রি করেন সুফিয়া বেগম। প্রায় ১০ বছর ধরে এই কাজ করছেন। স্বামী পলাশী বাজারে কুলির কাজ করেন। সুফিয়া পিঠা বিক্রি শুরু করেন বিকেল থেকে। চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘টাকা কী করেন? সুফিয়ার উত্তর, ‘আমি কী করুম? ট্যাকার হিসাব আমার স্বামীর কাছে। বিক্রি-বাট্টা শ্যাষ হইলে সব ট্যাকা হিসাব কইর‌্যা হের কাছে রাইখ্যা দেয়।’ ‘আপনি কোনো খরচ করেন না?’ ‘নাহ্, পিঠা বানানির চাল, গুড় তো সে-ই কিন্যা দেয়। আর সংসার খরচও হেই চালায়। আমি ট্যাকা দিয়া কী করুম?’ যখন তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলাম, স্বামী রফিক তাঁর পাশেই বসে ছিলেন। জিজ্ঞেস করলাম, আপনার স্ত্রী আয় করছেন, কিন্তু আপনি তাঁর আয়, তাঁর নিজের মতো খরচ করতে দিচ্ছেন না কেন? ‘ও ট্যাকা দিয়া কী করব? যা লাগে তা তো আমিই কিন্যা দেই। কাম করতাছে আমার সংসারের লাইগ্যা। আমি যদি বেশি রোজগার করতে পারতাম, তহন তো ওরে কাম করতে দিতাম না।’

একটি সরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন আফিয়া ইসলাম (ছদ্ম নাম)। তাঁর স্বামীও অন্য একটি ব্যাংকে কাজ করেন। আফিয়ার অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। তিনি সংসারের জন্য দৈনন্দিন বাজারসহ আরও কিছু খরচ করেন। তিনি কোথায় কত টাকা খরচ করলেন, সে হিসাবটা পুঙ্খানুপুঙ্খ নেন স্বামী। কোনো মাসে যদি মাকে একটা শাড়ি বা বাবার বাড়ির জন্য কিছু কেনেন, তখন সংসারে অশান্তি শুরু হয়। স্বামী অনুযোগ করেন, কী দরকার ছিল এই সব খরচের। বাড়তি খরচ না করে টাকা সংসারের জন্য রাখা উচিত, এমন অনেক কথা শোনান স্বামী। তাই মন চাইলেও সংসারে অশান্তির ভয়ে বাড়তি কোনো খরচ করেন না। নিজের পছন্দমতো একটি শাড়িও তিনি কিনতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘আয় করি ঠিকই, কিন্তু মনে হয় এই আয়ে আমার কোনো অধিকার নেই। আমি শ্রমিক মাত্র। কিন্তু আমার স্বামী কিন্তু তাঁর আয়ের কোনো হিসাব আমাকে দেবে, এটা কল্পনাও করতে পারি না।’ চারজন নারী। চারজনেরই নিজস্ব আয় আছে। অথচ তাঁদের কারোরই নিজস্ব আয়ের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। শুধু তাঁরাই নন। এই রকম চিত্র দেশের অনেক পরিবারেই রয়েছে।

যেসব নারী আয় করেন তাঁদের প্রায় ২৪ শতাংশেরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১ শীর্ষক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে গ্রামের তুলনায় শহুরে নারীদের নিজেদের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা বেশি আছে। এ জরিপে আরও দেখা গেছে, ৮৫ শতাংশ নারীর উপার্জনের স্বাধীনতাও নেই। মাত্র ১৫ শতাংশ নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পান। আবার যাঁরা নারীকে উপার্জন করতে দেন, তাঁদের মধ্যে ৯৩.১৯ শতাংশ স্ত্রীর উপার্জন করার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেন না।
 
আয়ের ওপর স্বামী বা শাশুড়ির হস্তক্ষেপের ফলে অনেক নারী কাজ করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। এঁদেরই একজন সাদিয়া চৌধুরী। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন তিনি। প্রথম প্রথম নিজের রোজগার নিজে ইচ্ছেমতো খরচ করতে পেরেছেন। কিন্তু কয়েক দিন না যেতেই স্বামী সব টাকা তাঁর হাতে তুলে দেওয়ার জন্য বলেন। যদিও স্বামীর আয় ভালো। একপর্যায়ে সাদিয়া চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর ভাষায়, ‘আমি যদি আমার নিজের টাকা খরচই না করতে পারব তাহলে আর চাকরি করা কেন?’

এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুরুষ ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমি এ বিষয়টির মধ্যে কোনো অন্যায় দেখি না। আমার স্ত্রী আমার ঘরের কাজ না করে, ঘরের লোকজনকে সময় না দিয়ে বাইরে গিয়ে উপার্জন করছে। এ জন্য তাকে অবশ্যই আমার সংসারে টাকা দিতে হবে। আর টাকাই যদি না দেয় তাহলে আমি স্ত্রীকে চাকরিই বা করতে দেব কেন? আর আমরা পুরুষেরা আমাদের আয়ের টাকাও তো আমরা সংসারে খরচ করি। তাহলে নারীরা কেন করবে না?’ এ বিষয়ে মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, ‘নারীর উপার্জিত অর্থে পুরুষের হস্তক্ষেপ লিঙ্গীয় বৈষম্যের প্রতিফলন। পুরুষ নারীকে কখনো এককভাবে একজন ব্যক্তি হিসেবে দেখে না। তারা ভাবে পরিবারের প্রয়োজনেই নারী আয় করেন, সুতরাং পরিবারের সবকিছু দেখভালের দায়িত্ব যেহেতু পুরুষের, তাই নারীর আয়ের ওপরও পুরুষের পুরোপুরি কর্তৃত্ব থাকা উচিত। পুরুষের এই মানসিকতা, মূল্যবোধ নারীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। আর এটাই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। আর এই ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হলে নারী-পুরুষ উভয়ের মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।’

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘নারীরা আয় করছে। অথচ সেই অর্থ খরচের স্বাধীনতা তার নেই। এটা দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা। পারিবারিক মূল্যবোধে সমস্যা রয়েছে। আর এসব সমস্যা দূর করতে হলে নারীকেই এগিয়ে আসতে হবে। নারীকে আরও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে। তাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। নারীকে শোষণ-নির্যাতনের হাত থেকে মুক্ত হতে হলে বাইরের কাজেও পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করতে হবে। দেশকে, দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে নারীকেও সব ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। অনেক বেশি সংখ্যক নারীকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হবে। যদিও দেখা যায় গার্মেন্টস সেক্টরে নারী শ্রমিকের হার বেশি। এ শিল্পের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই নারী। এটা আশার কথা। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রগুলোতে নারীর অংশগ্রহণের হার খুবই কম। এটা বাড়াতে হবে। প্রত্যেক মানুষকে উন্নতির শিখরে পৌছাতে হলে দক্ষতা, সততা, সময়জ্ঞান ও পরিবার- সমাজকে দেয়া প্রতিশ্রুতি- এই চারটি বিষয়কে ধারণ করতে হয়। নারীকেও এই চারটি বিষয় নিজের মধ্যে ধারণ করেই এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই নারীর অগ্রগতি সুনিশ্চিত।’



তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বাংলাদেশ

 

 
Our Another Site : Right Way BD | Right Way BD FB Group | Right Way BD FB Page |