গাড়ি ভাড়ার পয়সা নেই। তাই হেঁটেই চলতে হয় সোনিয়াকে। কিন্তু একটি পা নেই
তার। তবে মনের জোর আছে ষোলআনা। ক্র্যাচ বা লাঠি কিচ্ছু নেই। এক পায়ে লাফিয়ে
লাফিয়ে প্রতিদিন আড়াই কিলোমিটার পথ পেরিয়ে বিদ্যালয়ে যায় সে। সোনিয়া
খাতুন (১২) রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার ধোপাপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ
শ্রেণীর ছাত্রী। বাড়ি পুঠিয়ার পূর্ব ধোপাপাড়া গ্রামে। বাবার নাম মজিবুর
রহমান। তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী। কেউ তাঁকে কাজে নেন না। মা রহিমা বেগম এক
বেলা অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। আরেক বেলা মাঠে কাজ করেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে
সোনিয়া দ্বিতীয়। বড় বোন জলি খাতুনের লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। সেও
অন্যের বাড়িতে কাজ করে। ছোট ভাইটি প্রথম শ্রেণীতে পড়ছে।
গত ১১
ফেব্রুয়ারি সকালে ধোপাপাড়া বালিকা বিদ্যালয়ে গিয়ে সোনিয়াকে পাওয়া গেল।
শ্রেণীকক্ষে বসে ছিল সে। শিক্ষক নাম ধরে ডাকতেই এক পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে
এল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, মেয়েটি পড়াশোনায় ভালো।
এক পায়ে হেঁটে আসতে কষ্ট হয় তার। এ জন্য স্কুল থেকে তাকে দুই সেট বই দেওয়া
হয়েছে। এক সেট বই বিদ্যালয়েই থাকে। ও শুধু খাতা-কলম নিয়ে আসে। ডান পা ঊরুর
কাছ থেকে নেই। কারপেটিং উঠে যাওয়া সড়কে চলতে গিয়ে ইটের খোয়া লেগে পা কেটে
যায়। চিকিৎসার খরচ জোগানো বা কৃত্রিম পা লাগানোর মতো অবস্থা নেই পরিবারের।
কীভাবে
তার পা কাটা গেছে সোনিয়া বলতে পারে না। শুধু জানে দুই বছর বয়সে ট্রেনে তার
পা কাটা গেছে। সোনিয়া বলে, ছোটবেলা থেকেই এক পায়ে হাঁটতে শিখেছে সে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়টি বাড়ির পাশেই ছিল। এ জন্য কষ্ট হয়নি। কিন্তু মাধ্যমিক
বিদ্যালয় বাড়ি থেকে আড়াই কিলোমিটার দূরে হওয়ায় যাতায়াতে অনেক কষ্ট হয়। লাঠি
ব্যবহার করলে শরীরের ভারসাম্য রাখা যায় না। ওই দিন পূর্ব ধোপাপাড়া
গ্রামে সোনিয়ার বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মা রহিমা বেগমের সঙ্গে। তিনি বলেন,
অভাবের সংসার। তাই অন্যের বাড়িতে কাজ করেন।
সোনিয়ার দুর্ঘটনার কথা
জানতে চাইলে তিনি বলেন, একদিন সোনিয়াকে নিয়ে বড় জা মমতাজ বেগমের সঙ্গে
তাঁরা নওগাঁর আত্রাইয়ে ননদের বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছিলেন। মমতাজ দুই বছরের
সোনিয়াকে কোলে নিয়ে নাটোরের নলডাঙ্গায় রেলসেতু পার হচ্ছিলেন। রহিমা ভয়ে
সেতুতে না ওঠে নৌকায় নদী পার হন। এ সময় রেললাইন যাচাই করার জন্য একটি
ইঞ্জিনের বগি সেতুর ওপর চলে আসে। ওই ইঞ্জিনের বগিতে কাটা পড়ে মমতাজ
ঘটনাস্থলেই মারা যান। আর সোনিয়ার একটি পা কাটা পড়ে। পরে স্থানীয় লোকজন
মেয়েটিকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। এ ঘটনায়
রেলওয়ের লোকেরা ক্ষতিপূরণ দেবে বলে একটা কাগজে স্বাক্ষর নেন। পরে আর খোঁজ
নেননি। এখনো পায়ের ক্ষতস্থানে ঘা হয় সোনিয়ার। দুবেলা দুমুঠো ভাতের জোগাড়ের
পর চিকিৎসার টাকা থাকে না। রহিমা বেগম বলেন, ‘ওর পড়াশোনার খুব আগ্রহ।’
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বংলাদেশ।