Assertion For Justice, Equality And Freedom.

Tuesday, March 4, 2014

১১ নভেম্বর ’যৌতুকবিরোধী দিবস’ কেন নয়?

বিয়ের আসরে, কনে বিদায় কালে বরপক্ষের যৌতুক চেয়ে বসার দৃশ্য এক সময়ের বাংলা সিনেমায় হরেদরে দেখা যেত। কনের পরিবার টিভি, রেডিও, সাইকেল, মোটরসাইকেল, হাতঘড়ির সাথে নগদ টাকা না দিতে পারলে বরপক্ষ বিয়ের আসর ছেড়ে চলে যাওয়ার ধমক দিত। কনে তুলে নেয়ার পরও অর্থ দাবির পুন: পুন: বায়নাক্কা চলতই। টাকা জোগাড়ে কনে পরিবার ব্যর্থ হলে কনের জীবনে নেমে আসতো বিভীষিকা।


 
দেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে, নারীরা শিক্ষিত-সাবলম্বী হচ্ছে, সমাজের মানুষ নানা দিক দিয়ে সচেতন হচ্ছে, মুক্তচিন্তার প্রসার ঘটছে। এর ফলে অতীতের মত বরপক্ষ এখন আর খোলাখুলি যৌতুক চান না বিয়ের আসরে। বরং আজকাল ভিন্ন ঘটনা চোখে পড়ে। মেয়ের বিয়েতে সাগ্রহেই বরের জন্য ’এপার্টমেন্ট’ লিখে দেন কন্যাস্নেহে কাতর ধনাঢ্য পিতা।বোঝাই যায়, পরিস্থিতি পাল্টেছে, আগের মত মেয়ের বিয়ের সময় যৌতুকের সাইকেল কেনার সামান্য ক’টা টাকা জোগাড় করতে নাকেমুখে জল উঠে যায় না হালের কোন কোন পিতার। তারপরও বাস্তবতা হলো, সমাজে সব পরিবারের সামর্থ হাতের পাঁচটা আঙ্গুলের মতই অসমান। তারচেয়েও বড় কথা হলো বিয়েতে যৌতুক লেন এবং দেন অনৈতিক ও আইনগত দিক দিয়ে অবৈধ।

সামাজিক কাঠামো ধরে রাখার প্রয়োজনে সভ্য সমাজে বিয়ে একটি স্বত:সিদ্ধ প্রথা। নারী ও পুরুষ একে অপরের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেও পুরুষ মূলত বিয়ে ’করে’, আর নারীর বিয়ে ’হয়’ – আমাদের সামাজিক ধ্যান ধারনা এমনটাই। তবে যেহেতু আমরা শব্দ সচেতন হয়ে উঠছি ক্রমেই, তাই মানসিকতার বদল না হলেও, হালে অমন করে বলতে শোনা যায় না। বিয়ে সংক্রান্ত প্রচলিত এই আলাপ থেকে নারী ও পুরুষের সামাজিক অবস্থান মেপে নেয়া যায়। সামাজিক অবকাঠামোতে নারী ও পুরুষের প্রতি এই দৃষ্টিভঙ্গীগত বৈষম্য তা পূর্বে যতটা প্রকটভাবে ধরা পড়ত, আজকাল সেখানে কৌশলী খেলাধূলা চলে। দৃশ্যত হালের নারী সমাজ অনেক এগিয়েছে মনে হলেও কার্যত নারী নিপীড়ন পরিস্থিতির ক্রমাবনতিই নজরে আসে।

এডিস সন্ত্রাস, ধর্ষণ, উত্যক্তকরণ, অপহরণ, শারীরিক অত্যাচার – নারী নিপীড়ন ধরণেরই লম্বা ফর্দ দেয়া যাবে। দু:খজনক হলো, শহর কিংবা গ্রামে কেবল দুর্বৃত্তদের দ্বারাই নয়, অসংখ্য বিবাহিত নারীর জীবন শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে তারই স্বামী ও স্বামীর পরিবারের দ্বারা। হরহামেশাই সংবাদে পাওয়া যায়, নারী তার স্বামী ও স্বামীর পরিবার কর্তৃক পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাচ্ছে, হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে গোঙ্গাচ্ছে কিংবা কোন প্রতিকার খুঁজে না পেয়ে শেষমেষ আত্মহত্যা করছে।

সমাজ যেহেতু অবস্থানগত দিক দিয়ে নারীকে দুর্বল স্থানে বসিয়ে রাখে, তাই অন্যায়ের প্রতিবাদে ভুক্তভোগী নারীর প্রতিবাদের সুযোগ কম। বস্তুত আমাদের সমাজ ব্যবস্থা নারীর প্রতিবাদকে ’ন্যায্য’ মানতেও ইচ্ছুক নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমাজের চোখ রাঙানির ভয়ে নারীর নিজের পরিবারও তার পাশে দাঁড়ায় না। তাই নারীকে অনিচ্ছায়, পারিবারিক ও সামাজিক চাপের মুখে ’সো কল্ড’ সামাজিক (অপ)ব্যবস্থার সাথে নিদারুণ ’কমপ্রোমাইজ’ করতেই হয়। সমাজে গৎবাঁধা চর্চা এমনি। ব্যতিক্রম চোখে পড়ে কম। তাই যখন ব্যতিক্রম ঘটে তখন তা দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে, অনুসরণযোগ্য হয়ে ওঠে। ঠিক যেমনটা হয়ে উঠেছে ফারজানা। ফারজানা এখন যৌতুকবিরোধী প্রতিবাদের ’আইকন’ হিসেবে পরিচিত।

আসলে সমাজকে মাঝে মাঝে ভীষণ জোরে ঝাঁকি দিতে হয়। পদ্মরাগ উপন্যাসের নায়িকা জয়নাব বলেছিল, ‘আমি সমাজকে দেখাতে চাই একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী জন্মের চরম লক্ষ্য নহে। সংসার ধর্মই জীবনের সারমর্ম নহে।’ জয়নাবের মত করে সমাজকে ঝাঁকি দিতে পারে এমন কারো দেখা মেলে দৈবাৎ! যে বেগম রোকেয়ার নাম নিতে আমরা শ্রদ্ধাবনত হই তার বাণী ঠোঁটস্থ করলেও আত্মস্থ করতে পেরেছি ক’জন? মহীয়সী বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, ‘…বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রেও ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্ন-বস্ত্র নিজে উপার্জন করুক।’ সামগ্রিক বিষয় তো নারীর স্বাবলম্বী হয়ে বেড়ে ওঠার, গড়ে ওঠার। নয়তো কেবল ’সিদ্ধান্তহীনতার’ কারণেও নারীকে সামাজিক ও পারিবারিক প্রকোষ্ঠে ধুঁকে ধুঁকে ভুগতে হয়। স্বামী সাঈদ সম্পর্কে সময়মত ‘সিদ্ধান্ত’ নিতে পারেন নি বলে সাঈদের চুড়ান্ত বিভৎসতার মুখে পরে দৃষ্টি হারাতে হলো রুমানাকে। ফারজানাকে সাধুবাদ, তিনি এমন কোন দ্বান্দিকতার ফাঁদে পা দেন নি। হীরন ও তার ফুপুর যৌতুক বাঞ্ছার যথার্থ জবাব দিয়ে তিনি গোটা সমাজকে সজোরে ঝাঁকি দিতে পেরেছেন যথাসময়েই।

রুমানা মঞ্জুরের ঘটনায় কেউ কেউ নিরপেক্ষতার ভেক ধরে বলেছিলেন উভয় পক্ষের (সাঈদেরও) বক্তব্য শোনা প্রয়োজন। এদের মূল সুড়সুড়ি হলো, নিশ্চয়ই নারীটির কোন ’ঘটনা’ আছে! এবারও একইভাবে অনেকে ছুটে এসেছেন নারীর চরিত্র হননে। ‘তালাকপ্রাপ্ত হীরন’ নিজেই ফারজানার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনায় ভূমিকা রেখেছেন। যদিও সাংবাদিকদের জেরায় তিনি ’টেবিলের গ্লাস ছুঁয়ে’ কসম কেটে অনেক কথা নয়ছয় করে ফেলছেন, তবে তার নিজের বক্তব্যের ভারসাম্যহীনতাই তাকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছে। কেবল যৌতুক চাওয়ার কারণেই নয়, ফারজানাকে সামাজিকভাবে হয়রানি করতে ফেসবুকে ফারজানার ছবি ও ফোন নম্বর প্রকাশের মত ন্যাক্কারজনক আচরণটিকেও আইনের আওতায় এনে হীরনের বিচার হওয়া জরুরী।

এ কথা সত্য, ফারজানার জন্য আগামির সময়গুলো হবে চ্যালেঞ্জিং। সমাজ তার সাথে দু’তরফা আচরণ করবে। এক পক্ষে স্বাগত বচনের কমতি থাকবে না আক্ষরিক অর্থেই, বিপরীতে অন্য পক্ষের নানা আপত্তিকর কথার মধ্য দিয়ে চলতে হবে ফারজানাকে। ফারজানার প্রত্যয়ী কণ্ঠ অবশ্য বলে, তিনি বিচলিত হবার নন। কিন্তু লড়াইটা ফারজানার একার থাকবে কেন? আবু সুফিয়ান ব্লগে (http://blog.bdnews24.com/abusufianIR/49934) লিখেছেন, ফারজানার কথা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা হোক। যথার্থ প্রস্তাবনা। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে যৌতুকবিরোধী আলোচনা যুক্ত করা হোক অচিরেই। শিশু বয়স থেকে জেনে-বুঝে যৌতুক প্রথাকে ঘৃণা করতে শিখুক আগামির প্রজন্ম। যৌতুকবিরোধী আন্দোলনের অগ্রভাবে যৌতুকবিরোধী ব্যানার হাতে দাঁড়াক স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। আগামির প্রজন্ম যৌতুকপ্রথা বিলুপ্ত সমাজে বাস করবে, এ নিশ্চয়তার বীজ প্রোথিত হোক এখনই।

পত্রিকা ঘেঁটে হালের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালে যৌতুকের শিকার হয়েছে ২৮৫ জন, যৌতুকের কারণে স্বামীর হাতে খুন হয়েছে ১৯৪ জন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০ সালে যৌতুকের কারণে আত্মহত্যা করে ২২ জন নারী। যৌতুকে অস্বীকৃতি জানানো নারীর নাগরিক অধিকার। আশ্চর্যজনক হলো, যৌতুকপ্রথার প্রচলন, চর্চা এবং কুফল বহুকালের পুরনো হলেও নারীর এ নাগরিক সমস্যাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করতে যৌতুকপ্রথা বিরোধী কোন দিবস নেই! যৌতুক বিরোধিতা করে ফারজানার এ প্রতিবাদকে স্বীকৃতি, সন্মান ও সমর্থন জানিয়ে ও যৌতুকবিরোধী ক্যাম্পেইনকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দিতে আমাদের ’যৌতুকবিরোধী দিবস’ পালনের পদক্ষেপ নেয়ার সময় এখনি।

যৌতুকের প্রতিবাদে ফারজানা যেদিন হীরনকে তালাক দেয়, সেদিন ছিল ১১.১১.১১। সংখ্যার বিশেষ বিন্যাসের কারণে এই তারিখটি বিশ্বজুড়ে নানাভাবে পালিত হয়েছে। সবার উৎসাহ ছিল, দিনটিকে কতটা অভিনবভাবে স্মরণীয় করে তোলা যায়। দ্ব্যার্থহীনভাবে বলা যায়, ফারজানার মত এ দিনটিকে এমন বিশেষত্ব দিতে পারে নি আর কেউ। বিশ্ব ১১.১১.১১’র গল্পকে ধারণ করতে চেয়েছিল আগামির জন্য। সাহসী ফারজানার প্রতিবাদী গল্পটা ’১১ নভেম্বর’ -এর প্রতীক হয়ে উঠুক, কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। প্রতি বছর ‘১১ নভেম্বর’ পালিত হোক ’যৌতুকবিরোধী দিবস’।



আইরিন সুলতানা,  ব্লগার।
Source: bdnews24.com

 
Our Another Site : Right Way BD | Right Way BD FB Group | Right Way BD FB Page |