নয়তলা ভবনটি মাথার ওপর পড়ার পরও মরতে মরতে বেঁচে ছিলেন শাহীনা আক্তার। ধসের
৮০ ঘণ্টা পর তাঁকে জীবিত খুঁজে পান উদ্ধারকারী কিছু তরুণ। এর পরের ৩০
ঘণ্টা তাঁকে বাঁচানোর মরণপণ লড়াই করেন স্বেচ্ছাসেবক এবং সেনাবাহিনী ও ফায়ার
সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় অপ্রত্যাশিত
অগ্নিকাণ্ড। মরতে মরতে বেঁচে থাকা সেই শাহীনা বাঁচতে বাঁচতেই মারা গেলেন। গতকাল সোমবার
বিকেলে তাঁর লাশ উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকারীদের ধারণা, বয়স তাঁর ২৫ থেকে
৩০-এর মধ্যে। শত শত মৃত্যুর ভিড়ে জীবনসংগ্রামী এই নারীর মৃত্যু কাঁদিয়েছে
সবাইকে। শোকাবহ পরিবেশের মধ্যে তাঁর লাশ নিয়ে চলেছে টানাহেঁচড়া। ধ্বংসস্তূপের ভেতরে
থাকার সময় উদ্ধারকারীদের শাহীনা বলেছিলেন, তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ায়। গতকাল
তাঁর বাবা মোতালেব গোলদার লাশ শনাক্ত করে জানান, তাঁর বাড়ি পটুয়াখালীর
কলাপাড়ায়। শাহীনা ও তাঁর বাবার বক্তব্যে ঠিকানার গরমিলের কারণে উপজেলা
প্রশাসন ও পুলিশ চার ঘণ্টা পর লাশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। এই চার ঘণ্টা
লাশটি রাখা হয় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের বারান্দায়। সেখানেও শাহীনাকে
একনজর দেখতে আসেন অনেকে।
শাহীনাকে উদ্ধার করতে গিয়ে রড কাটার সময় গত রোববার রাত ১১টার দিকে
ধ্বংসস্তূপের ভেতরে আগুন লেগে যায়। এরপর গতকাল বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত
ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। আগুন নিয়ন্ত্রণের পর বিকেল
চারটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করতে যান। কিন্তু শাহীনা
তখন মৃত। উদ্ধারের পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকর্মীরা তাঁর লাশ ঘিরে গোল
হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়ান। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন কয়েকজন। শাহীনাকে উদ্ধারের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন ওশান বয়েজ নামের তরুণদের একটি
সংগঠনের কর্মীরা। সেই তরুণদেরও লাশ দেখতে খবর দেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
মৃত মুখ দেখে তাঁরাও কান্নায় ভেঙে পড়েন। বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শাহীনার
লাশ ধ্বংসস্তূপের ওপর থেকে নিচে নামানো হলে উপস্থিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী
বাহিনী, স্থানীয় মানুষ ও গণমাধ্যমের কর্মীরাও চোখের পানি আটকাতে পারেননি।
পরে অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশটি অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে নিয়ে যাওয়া
হয়। বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে শাহীনার ফুফু দাবিদার আকলিমা বেগম লাশ দেখেই
চিৎকার করে বলেন, ‘পাইছি, আমার মারে পাইছি।’ এরপর শাহীনার বাবা মোতালেব লাশ
শনাক্ত করেন। এ সময় সাভার থানা পুলিশের সদস্যরা নিয়ম অনুযায়ী নিহত
ব্যক্তির নাম-ঠিকানা সংগ্রহের সময়ই ঝামেলা বাধে। মোতালেব বলেন, তাঁর বাড়ি
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নিশানবাড়িয়া গ্রামে। কিন্তু পুলিশের কর্মকতারা বলেন, মৃত্যুর আগে শাহীনা গণমাধ্যম ও
উদ্ধারকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময় জানিয়েছিলেন, তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ায়।
মোতালেব দাবি করেন, শাহীনার স্বামীর বাড়ি কুষ্টিয়ায়। স্বামীর নাম আসানুর
রহমান। শাহীনার দেড় বছরের একটি ছেলে রয়েছে। এরপর শুরু হয় শাহীনার স্বজনদের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশের দেনদরবার।
সাভার থানার উপপরিদর্শক মো. মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, শাহীনার মৃত্যুর
আগের বক্তব্য ও তাঁর বাবা দাবিদার ব্যক্তির বক্তব্যে গরমিল রয়েছে। এর আগে
এক ব্যক্তি তিনটি লাশ তাঁর আত্মীয়ের বলে দাবি করে দাফন খরচ বাবদ ৬০ হাজার
টাকা বুঝে নিয়ে লাশ রেখে পালিয়ে যান। এ জন্য তাঁরা সাবধানতা অবলম্বন করছেন। সাভার উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান রোকেয়া হক বলেন, যেহেতু বক্তব্যে গরমিল
রয়েছে, তাই সাবধানতা হিসেবে ডিএনএ টেস্টের কথা চিন্তা করেছিলেন তাঁরা।
তবে শাহীনার বাবা মোতালেব গোলদার বলেন, তাঁর বাঁ হাতের তর্জনী আঙুলে সাপ
কামড়েছিল। সেই আঙুল পরে বাঁকা হয়ে যায়। মাঠে উপস্থিত রোভার স্কাউটের
কর্মীরা পরীক্ষা করে দেখেন, আসলেই ওই আঙুল বাঁকা। মোতালেব গোলদার গেন্ডার একটি বাড়িতে নিরাপত্তাকর্মীর কাজ করেন। সেই বাড়ির
বাসিন্দা মেহনাজ তাবাসসুম বলেন, টিভিতে শাহীনাকে দেখে তাঁরাই মোতালেবকে
জানান এটি তাঁর মেয়ে। এরপর তাঁরা লাশ নিতে এসেছেন। একপর্যায়ে পুলিশের এসআই মোস্তফা শাহীনার বাবাকে বলেন, ‘আপনি একটা বাটপার।
আপনাকে জুতা দিয়ে মারা উচিত।’ এ কথা শুনেই উপস্থিত জনতা খেপে উঠে ওই
পুলিশের ওপর চড়াও হন। পরে রোভার স্কাউটের সদস্যরা এসে তাঁকে উদ্ধার করেন। রাত পৌনে ১০টার দিকে শাহীনার লাশ তাঁর বাবা মোতালেব গোলদারের কাছে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত হয়।
শাহীনাকে উদ্ধার করতে শনিবার থেকেই চেষ্টা করছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব
মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ও স্বনিয়োজিত উদ্ধারকর্মী রকিবুল মুরাদ।
গতকাল বিকেলে অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে শাহীনার লাশ দেখতে এসে মুরাদ
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, শনিবার মাগরিবের নামাজের সময় কয়েকজন তরুণ তাঁকে
শাহীনার বেঁচে থাকার কথা জানান। অষ্টম তলা থেকে ছাদ ফুটো করে তৃতীয় তলায়
নামেন তিনি। এরপর সরু একটা সুড়ঙ্গ দিয়ে কিছু দূর যাওয়ার পর দুই ইঞ্চির মতো
ফাঁকা দুটি বিমের পেছনে শাহীনাসহ চারজন জীবিত দেখতে পান। তখন শাহীনা ও
কল্পনা নামের দুজনের সঙ্গে কথাও বলেন তিনি। বিম দুটো এমনভাবে সামনে পড়েছিল
যে সামান্য ফাঁকা থাকলেও তা দিয়ে একটা পানির বোতলও ঢোকে না। পানির বোতলের
মধ্যে গ্লুকোজ মিশিয়ে পাইপ দিয়ে তাঁদের পান করতে দেওয়া হয়। কখনো দেওয়া হয়
স্যালাইন। তবে মাঝেমধ্যেই তাঁরা সাদা পানি পান করতে চাইছিলেন।
রকিবুল মুরাদ জানান, পানীয় ছাড়াও তাঁদের জন্য অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়।
এসব দিয়ে বাঁচিয়ে রেখে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ও তরুণেরা মিলে বিম কেটে
তাঁদের বের করার রাস্তা তৈরি করছিলেন। কিন্তু সরু সুড়ঙ্গে শুয়ে শুয়ে বেশি
কাটা যাচ্ছিল না। রোববার বিকেলেও শাহীনার সঙ্গে কথা হয় তাঁর। টাইলস কাটার
সময় খণ্ডিত অংশবিশেষ হাত দিয়ে সরিয়ে সাহায্য করেছিলেন ওই নারী। এভাবে উদ্ধার-প্রক্রিয়া চলার মধ্যে বৈদ্যুতিক রড কার্টার ব্যবহার করা হয়।
রাত ১১টার দিকে রড কাটার সময় স্ফুলিঙ্গ থেকে আবদুল আজিজ নামের এক
স্বেচ্ছাকর্মীর গায়ে আগুন লেগে যায়। সবাই কোনো রকমে বের হয়ে আসেন। আজিজ
পুড়ে যান। এরপর পাওয়া যায় শাহীনার লাশ।