ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ডিএমসি) ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে ধর্ষণের শিকার নারীর
শারীরিক পরীক্ষা করেন পুরুষ চিকিৎসক। ওই চিকিৎসককে সহায়তা করেন পুরুষ
ওয়ার্ডবয়। দেশের সবচেয়ে গৌরবময় চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের প্রমাণপত্র নিতে
এসে নারীকে চরম লজ্জা আর অপমানের মুখোমুখি হতে হয় প্রায়ই। ধর্ষণ, হত্যা, দুর্ঘটনার মামলা অথবা ছেলে বা মেয়ের বয়স নির্ধারণে ফরেনসিক
মেডিসিন বিভাগ থেকে সনদ নিতে হয়। আইনের চোখে এ সনদ গুরুত্বপূর্ণ দলিল।
অনেকে মনে করেন, এ দলিল পেতে দ্বিতীয়বার ধর্ষণের শিকার হন নারী। ঢাকা
মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে কোনো নারী চিকিৎসক নেই। কোনো নারী নার্স,
এমনকি আয়াও নেই। অধ্যাপকসহ নয়টি চিকিৎসকের পদের একটিতেও নারী নেই। ১৫ বছর
আগে বিভাগটি প্রতিষ্ঠিত হলেও এত দিনে পিয়ন পদে একজন নারী ছাড়া আর কোনো পদে
কোনো নারীকে পদায়ন করা হয়নি।
এ বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ কাজী দ্বীন মোহাম্মাদ গত ২৪ মার্চ প্রথম আলোকে
বলেন, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে একজন নারী চিকিৎসককে ওই বিভাগে পদায়ন করা
হবে। তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসাশাস্ত্রে নারী-পুরুষের কাজ আলাদা করে দেখার
কোনো সুযোগ নেই।’ কিন্তু ১৫ এপ্রিল ফরেনসিক বিভাগের প্রধান মোখলেছুর রহমান প্রথম আলোকে
জানান, তিনি এখনো এ বিভাগের জন্য নারী চিকিৎসক নিয়োগ বা পদায়ন বিষয়ে কোনো
নির্দেশনা পাননি। সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই বিভাগে শারীরিক পরীক্ষার জন্য পৃথক কক্ষ নেই।
চিকিৎসকদের বসার কক্ষের সামনের বারান্দায় একটি টেবিল রাখা। পুরুষ চিকিৎসক
পুরুষ ওয়ার্ডবয়ের সহযোগিতায় সেই টেবিলের ওপর ধর্ষণের শিকার নারীকে রেখে
তাঁর পরিধেয় কাপড় খুলে শারীরিক পরীক্ষা করেন। ওই একই টেবিলে এবং একইভাবে
পরীক্ষা করে বয়স নির্ধারণ করা হয় নারী-শিশু সবার। আর এভাবে পরীক্ষার
মুখোমুখি হয়ে আঁতকে ওঠেন সবাই। পরীক্ষার আতঙ্কে অনেকে অন্যায়ের প্রতিকার
চাওয়া থেকে বিরত থাকেন।
সম্প্রতি ময়মনসিংহের এক পোশাকশ্রমিক ধর্ষণের মামলা করেন। এ আয়োজন দেখে পরীক্ষা না করেই ফিরে যান তিনি। সবুজবাগ থানার সহকারী পুলিশ পরিদর্শক বিকাশ কুমার ঘোষ আদালতের নির্দেশে বয়স
নির্ধারণের জন্য একটি মেয়েকে ফরেনসিক বিভাগে আনেন। খোলা বারান্দার টেবিলের
ওপর পুরুষ ওয়ার্ডবয় কাপড় খুলতে শুরু করলেই চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন
মেয়েটি। জ্ঞান ফেরার পর বয়স নির্ধারণে আর রাজি হননি তিনি। এই প্রতিবেদককে মেয়েটি বলেন, তাঁর বয়স ১৯ বছর দুই মাস। এইচএসসি পাস করলেও
সনদে তাঁর বয়স কম দেওয়া হয়। সনদে তাঁর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি। নিজের ইচ্ছায়
বিয়ে করায় মেয়েটির বাবা মামলা করেছেন তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে। আদালতে হাজির
হয়ে নিজের ইচ্ছায় বিয়ের কথা স্বীকার করেন মেয়েটি। কিন্তু সনদ অনুযায়ী বয়স
কম হওয়ায় তাঁকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে পাঠিয়ে দেন আদালত। মেয়েটি নিজেই
আদালতের কাছে ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে তাঁর বয়স নির্ধারণের আবেদন জানান।
আদালত বয়স নির্ধারণের জন্য সবুজবাগ থানার পুলিশকে নির্দেশ দেন।
ডিএমসিতে প্রতিদিন ধর্ষণ ও বয়স নির্ধারণের এক-দুটি ঘটনা আসে। পরীক্ষা না করেই এঁদের কেউ কেউ ফিরে যান। অন্যদিকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, টাকা দিতে রাজি হলে হাসপাতালের অন্য বিভাগ
থেকে নারী চিকিৎসক এনে পরীক্ষা করানো হয়। টাকা বেশি দিলে ওই দিনই পরীক্ষা
সনদও পাওয়া যায়। এসব ক্ষেত্রে পাঁচ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়
অভিভাবকদের কাছ থেকে। টাকা খরচ না করলে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয় ধর্ষণ
কিংবা বয়স নির্ধারণের প্রতিবেদনের জন্য।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু বলেন, ডিএমসিতে প্রায়
প্রতিদিনই কোনো না কোনো ধর্ষণের শিকার নারীকে নিয়ে যেতে হয় পরীক্ষা করানোর
জন্য। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানানোর পরও ফরেনসিক বিভাগে নারী চিকিৎসক
বা নার্স পদায়ন করা হয়নি। এটা দুঃখজনক। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এম নিয়াজউদ্দিন প্রথম আলোকে
বলেন, বিষয়টি তিনি প্রথম শুনলেন। কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুত
নারী চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হবে।
উৎসঃ দৈনিক প্রথম আলো