হাঁটার
জন্য দুটি পা নেই। হাত দুটি ভালো ছিল। আগুন লেগে তারও একটি পুড়ে গেছে।
লেখাপড়া শেখার আগ্রহ ছিল। বই-খাতা ছিল না। কাঠি দিয়ে মাটিতে বর্ণমালা লিখতে
শিখেছিল। অদম্য ইচ্ছাশক্তির কাছে শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
একসময় বাবা-মা মারা যান। তবু মনোবল ফুরায় না তাঁর। লেখাপড়া শিখে নিজেই
অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেন। পেয়ে যান দেশের প্রথম প্রতিবন্ধী
নারী উদ্যোক্তা পুরস্কার।
ঠিক সাগর সেচে মুক্তা আনার মতো সাহস দেখানো মেয়েটির নাম নার্গিস আক্তার ওরফে শরীফা। রাজশাহী নগরের রামচন্দ্রপুর মহল্লায় এক দরিদ্র পরিবারে ১৯৮৩ সালে শরীফার
জন্ম। বাবা শরিফুল ইসলাম ও মা মসিয়া বেগম। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে শরীফা
সবার ছোট। তাঁর সবার আদর পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু প্রতিবন্ধিতার কারণে সবার
বোঝা হয়ে যান। তাঁর হাঁটুর নিচ থেকে পা দুটি পেছনের দিকে ভাঁজ করা। খেলার
সাথিরা তাঁর এ অচল দুটি পা ধরে টানত। আর মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যেতেন তিনি। মাটিতে কাঠি দিয়ে বর্ণমালা লেখার চেষ্টা করতে দেখে মায়ের পীড়াপীড়িতে বাবা
বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন। এক প্রতিবেশীর বাড়িতে সারা দিনের জন্য মা রেখে
আসতেন তাঁকে। সেই বাড়িতে ছিল ‘পদ্মমুনি হস্তশিল্প’ নামের একটি কুটিরশিল্পের
প্রতিষ্ঠান। সেখানে মাটি দিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য ও ঘর
সাজানোর শোপিস। সেগুলো তৈরি করা দেখে শেখার চেষ্টা করতেন শরীফা। একসময় কিছু
কাজ শিখেও ফেলেন। সেখান থেকে সামান্য যা আয় হতো, তা দিয়ে বিদ্যালয়ে
পড়াশোনা শুরু করেন।
এভাবেই ১৯৯৮ সালে এসএসসি পাস করেন শরীফা। কিন্তু সে বছর
কলেজে ভর্তির আগেই বাবা মারা যান। ভাইয়েরা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে আলাদা হয়ে
যান। বন্ধ হয়ে যায় শরীফার কলেজে পড়ার স্বপ্ন। তবে এবার শুরু হয় নতুন করে
বেঁচে থাকার সংগ্রাম। বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন, কুটিরশিল্পের কাজ এবং সেলাই
মেশিনে ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন তিনি। এ ছাড়া বসতবাড়ির চারপাশে
শাকসবজি চাষ করতে থাকেন। তা দিয়েই কোনোমতে দিন চলে যেত। এরই মধ্যে ২০০০
সালে মারা যান শরীফার মা। এবার শরীফা যেন পৃথিবীতে একেবারে নিঃসঙ্গ। একসময় জানতে পারেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে সনদ ও ঋণ
দেওয়া হয়। তিনি সমাজসেবায় যোগাযোগ করে নিজের সম্পর্কে জানান এবং পাঁচ
হাজার টাকা ঋণ পান। তা দিয়ে দুটি ভালো জাতের ছাগল কেনেন। তা ছাড়া তাঁর
মায়ের রেখে যাওয়া দুটি গাভি ছিল। একটি গাভির বাচ্চা হলে বাড়ি বাড়ি দুধ
বিক্রি করে আস্তে আস্তে ঋণ পরিশোধ করতে থাকেন। বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে পরিচয় হয় আবদুর রহিম ওরফে মনা
নামের এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয় গড়ায় পরিণয়ে। সুন্দর চেহারার এই মানুষটির
মনটা আরও সুন্দর। ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তাঁদের বিয়ে হয়।
২০০৬ সালের কথা। শরীফ-রহিম দুজনে খুব ছোট পরিসরে একটি উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান খোলার উদ্যোগ নেন। নাম দেন ‘এল এস কেমিক্যাল কোম্পানি’। এ জন্য তাঁরা পুঁজির সন্ধানে নেমে পড়েন। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি সব বিক্রি
করে দেন। তাতে কিছু হয়। কিন্তু আরও টাকার প্রয়োজন। ঋণের কথা ভাবেন। এ জন্য
ব্যাংকে ধরনা দেন। সিঁড়ি বেয়ে ব্যাংকের ওপর তলায় ওঠা-নামা করতে করতে শরীফার
দুই হাঁটুতে ফোসকা পড়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে তাঁর গর্ভের
প্রথম সন্তানটিও গর্ভেই মারা যায়। পরে সেই ঋণও মেলেনি। অনেক কিছু করে অবশেষে সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে ২০ হাজার টাকা ঋণ পান। সঙ্গে
স্বামীও কিছু টাকা দেন। সব মিলিয়ে পুঁজি দাঁড়ায় দুই লাখ টাকা। ২০০৬ সালে
খুব ছোট পরিসরে তাঁর কারখানার যাত্রা শুরু হয়। পরের বছরই সরকারি অনুমোদন
পান। কারখানায় উৎপাদন শুরু হয়। তবে মালিক নন, শরীফা প্রথম ব্যবসা শুরু করেন
শ্রমিক হয়ে। পণ্য নিয়ে বাজারে বাজারে বিক্রি করতেন। এভাবে দূর-দূরান্তে
তাঁর পণ্যের বাজার তৈরি করেন। কখনো ক্লান্তিকে প্রশ্রয় দেননি। একটু একটু
করে টাকা জমিয়ে মেশিন কেনেন। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্রপাতি সংগ্রহ হয়নি।
ব্যবসা হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগোচ্ছিল, ঠিক তখনই তাঁর জীবনে নেমে আসে
আরেকটি বিপর্যয়।
২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে রান্না করতে গিয়ে গায়ে আগুন লেগে সারা শরীর পুড়ে
যায়। স্বামী তাঁকে অজ্ঞান অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করেন। ঢাকায় দুই মাস
চিকিৎসাধীন ছিলেন। এতে বাঁ হাতটি অকেজো হয়ে যায়। তবু তিনি থেমে যাননি। ডান
হাত দিয়েই শুরু করেন কাজ। তাঁর কারখানায় যে পণ্যগুলো উৎপাদন হয়, তা বিক্রি
করার জন্য কিছু বিক্রয় কর্মকর্তা, এলাকা ব্যবস্থাপক, পরিবেশক ও কিছু
সুবিধাবঞ্চিত নারী মাঠপর্যায়ে কাজ করেন। তাঁর এ কোম্পানিতে বর্তমানে প্রত্যক্ষভাবে ২০ জন এবং পরোক্ষভাবে নয়জনের
কর্মসংস্থান হয়েছে। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন প্রতিবন্ধীও রয়েছে। শরীফার
কোম্পানিতে তৈরি করা পণ্যের মধ্যে রয়েছে স্ক্রিন ক্রিম, উপটান, লোশন,
নেইলপলিশ ইত্যাদি। কয়েক দিন আগে কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, শরীফা কর্মীদের নিয়ে কাজ করছেন।
তাঁদের মধ্যে শাম্মী আক্তার (১৯) নগরের শাহ মখদুম কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে
পড়াশোনা করেন। পড়াশোনার পাশাপাশি এ কাজ করেন। প্রতিবন্ধী সেতারা খাতুন (১৯)
এবার রাজশাহী সরকারি মহিলা কলেজে সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছেন। তিনি
পড়াশোনার পাশাপাশি এখানে কাজ করেন। সেতারা খাতুন বলেন, ‘আমরা শরীফা আপার কারখানায় শুধু কাজ করি তা নয়, তাঁর কাছে অনেক কিছু শিখি।’ কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ সবচেয়ে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে শরীফা ‘অ্যাকসেস
বাংলাদেশ-অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ সম্মাননা ২০১২’-এর প্রথম পুরস্কার পেয়েছেন।
সম্প্রতি শরীফার কোলজুড়ে এসেছে একটি ফুটফুটে কন্যাসন্তান।
শরীফার কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণবিষয়ক সরকারি
প্রতিষ্ঠান বিএসটিআইয়ের রাজশাহীর উপপরিচালক রেজাউল করিম সরকার বলেন,
বিএসটিআইয়ের আওতাধীন যে কয়টি আইটেম তাঁদের রয়েছে, সেগুলো পরীক্ষার পর মান
যাচাই করে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শরীফার জীবন অনেক দুঃখে গড়া। তাই তিনি দুঃখী মানুষের কথা মনে রেখেছেন।
প্রতিবন্ধীদের কোনো অনুষ্ঠানে, দরিদ্র মানুষের যেকোনো প্রয়োজনে সাধ্যমতো
পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি। শরীফার কথা, প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের
একটি অনুদান থাকা উচিত, যার মাধ্যমে তারা সামনে এগিয়ে দিতে পারবে।