ছয় নারী। যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখ। চার দশকের বেশি সময় লোকচক্ষুর অন্তরালে
থেকে, সামাজিক নিগ্রহ সয়ে জীবনটাকে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন। কেউ জানতেও পারেননি
বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে এঁরা জীবন বাজি রেখেছেন। তাঁরা সবাই
মুক্তিযোদ্ধা। গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে এই ছয় নারী
মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো। মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী, নিজ নিজ
ক্ষেত্রে উজ্জ্বল নারীরা দেশের আনাচকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নারী
মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানালেন। কেন এঁরা
লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন, কেন স্বীকৃতির জন্য এতটা কাল অপেক্ষা করতে হলো,
সেই ভাবনা থেকে চোখ মুছলেন দেশের বরেণ্য ব্যক্তিরা।
স্বাধীনতার মাসের
প্রথম দিনে এবং আন্তর্জাতিক নারী দিবসের ঠিক এক সপ্তাহ আগে নারী
মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা হলো। প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা
শারমীনের উপস্থাপনা, অদিতি মহসিনের গান এবং সংবর্ধিত নারী আর সুধীজনদের
কথায় অনুষ্ঠানে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ছয় মুক্তিযোদ্ধা হলেন:
পুষ্পরানী শুল্কবৈদ্য, মালতী রানী শুল্কবৈদ্য, হীরামনি সাঁওতাল, ফারিজা
খাতুন, সাবিত্রী নায়েক ও রাজিয়া খাতুন। চেতনা ৭১ হবিগঞ্জের মহাসচিব কেয়া
চৌধুরীর সাত বছরের চেষ্টায় গত বছরের ৯ ডিসেম্বর এই মুক্তিযোদ্ধারা
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পান। এঁদের কেউ সম্মুখসমরে অংশ নিয়েছেন, কেউ সন্তানসহ
সেনা ক্যাম্পে অবরুদ্ধ ছিলেন দিনের পর দিন এবং কেউ বোমার আঘাতে অঙ্গ
হারিয়েছেন।
বোমার আঘাতে পা হারানো ফারিজা খাতুনকে কৃত্রিম পা লাগানোয়
সহযোগিতা করেছে প্রথম আলো। এ জন্য খরচ হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। এর বাইরে প্রথম
আলোর পক্ষ থেকে আরও ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয় ফারিজা খাতুনকে। অন্য পাঁচজনের
প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হয়। কৃত্রিম পা পেয়ে ভীষণ
খুশি ফারিজা খাতুন। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা ভিখারির মতন। কত ঘাটে গেছে। কত
চেষ্টা করছে। এখন আমি হাঁটিয়ে বেড়াই। আমি খুবই খুশি।’ রণাঙ্গনের অধিনায়ক
কে এম সফিউল্লাহকে কাছ থেকে দেখেই চিনে ফেলেন রাজিয়া খাতুন। পাকিস্তানি
বাহিনীর হাত থেকে পালিয়ে সম্মুখসমরে অংশ নেন তিনি। এ ছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের
কাছে অস্ত্র পৌঁছে দিয়েছেন এবং গুপ্তচরের কাজ করেছেন অসম সাহসিকতায়।
অনুষ্ঠানে
এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘আজও মা-বোনদের স্বীকৃতি দেওয়ার
মতো মনমানসিকতা হয়নি আমাদের। এই রাজিয়া আমার ক্যাম্পের শিক্ষার্থী ছিল।
মা-বোনেরা মুক্তিযুদ্ধের সময় থাকার জায়গা দিয়েছেন, কোথায়-কখন পাক বাহিনী
আসবে, তার খবর এনে দিয়েছেন। তাঁদের স্বীকৃতি যত দিন না আমরা দেব, তত দিন
আমাদের কাজ শেষ হবে না।’ মানবাধিকারকর্মী হামিদা হোসেন তাঁদের খুঁজে বের করার জন্য ধন্যবাদ জানান কেয়া চৌধুরীকে।
সাবেক
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, ‘তেলিয়াপাড়ায়
রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছিল। এই ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধা সেখান থেকে খুব দূরে
ছিলেন না। অথচ তাঁদের খুঁজে বের করা যায়নি। এই ব্যর্থতা আমাদের।’ কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন বলেন, এই ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধা বাঙালির অস্তিত্ব, পরিচিতি, স্বাধীনতা। নারীনেত্রী
আয়শা খানম বলেন, বিভিন্ন এলাকায় যাঁরা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন,
তাঁদের খুঁজে বের করে স্বীকৃতি দিতে হবে। এ কাজ সরকারের একার নয়। সেন্ট্রাল
উইমেনস ইউনিভার্সিটির উপাচার্য পারভীন হাসান বলেন, সিরাজগঞ্জে এমন ২১ জন
নারী আছেন, তাঁদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দেশের আনাচকানাচে এমন
আরও নারী আছেন। তাঁদের স্বীকৃতি দিতে হবে। ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধার প্রতি
গভীর শ্রদ্ধা জানান সাবেক সাংসদ সারাহ বেগম কবরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক আমেনা মহসীন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা
আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী ও প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর
রহমান।
এই ছয় নারী মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করা এবং তাঁদের
মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাটা যে সহজ কাজ ছিল না, তা বলতে গিয়ে
কেঁদে ফেলেন কেয়া চৌধুরী। তিনি এ কাজ শুরু করেন ২০০৭ সালে। অনেক বাধা, অনেক
কষ্ট ও চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তিনি সফল হন ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। এভাবে নারী
মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করে স্বীকৃতি আদায় বা সরকারি গেজেটভুক্ত করার
ঘটনা এটাই প্রথম বলে জানান কেয়া চৌধুরী। এ কাজে যাঁরা সহায়তা করেছেন, তিনি
তাঁদের ধন্যবাদ এবং প্রথম আলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
ছয় নারী
মুক্তিযোদ্ধাকে চেক ও উপহার তুলে দেন মেজর জেনারেল (অব.) কে এম সফিউল্লাহ,
মেজর জেনারেল (অব.) আজিজুর রহমান, বিমানবাহিনীর ক্যাপ্টেন (অব.)
সাহাবুদ্দিন আহমেদ বীর উত্তম, বিমানবাহিনীর ক্যাপ্টেন (অব.) আকরাম আহমেদ
বীর উত্তম, লে. কর্নেল (অব.) এস আই নূরুন্নবী খান বীর বিক্রম, মেজর জেনারেল
(অব.) জামিল ডি আহসান বীর প্রতীক। উপস্থিত ছিলেন মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান
বীর প্রতীক। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল নারীদের মধ্যে ছিলেন
অধ্যাপক মালেকা বেগম, শাহীন আনাম, মেহতাব খানম, তাজিন আহমেদ, শামসুন্নাহার,
বিটপি দাশগুপ্ত, মিনু হক, আলিয়া নাহিদ, ফারাহ কবীর, তানিয়া হক প্রমুখ।
তথ্যসুত্রঃ প্রথম আলো, বংলাদেশ।