আফসানার বয়স গত মাসে ১২ বছর পার হয়েছে। কিন্তু সে এখনো ঠিকভাবে কথা
বলতে পারে না। নিজের হাতে খেতে পারে না। এমনকি হাঁটতেও পারে না। সারা দিন
সে বিছানায় শুয়ে থাকে। তার দেখাশোনা করতে করতেই তার মায়ের দিনরাত কেটে
যায়। আফসানার এ অবস্থার কারণ, সে জন্ম থেকেই বুদ্ধি ও শারীরিক প্রতিবন্ধী। আফসানার
মতো এ রকম বহু প্রতিবন্ধী শিশু আমাদের দেশে অসহায় জীবনযাপন করছে। কিন্তু
একটু যত্ন আর একটু ভালোবাসা পেলে যে তারাও স্বাবলম্বী হতে পারে, দেশের
উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, সেটা অনেকেই মনে করে না।
প্রতিবন্ধিতা-বিষয়ক
জাতীয় নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিশু বলতে অসুস্থতার কারণে,
দুর্ঘটনায়, চিকিৎসাজনিত ত্রুটি বা জন্মগতভাবে অথবা কারও অবহেলার কারনে যদি কারও শারীরিক ও মানসিক
অবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাধ্যমে কর্মক্ষমতা আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে লোপ
পায় বা তুলনামূলকভাবে কম হয়, তাহলে সেই শিশু প্রতিবন্ধী।
প্রতিবন্ধিতার
ধরনগুলো হচ্ছে: ১. অটিজম, ২. চলনপ্রতিবন্ধিতা, ৩. দীর্ঘস্থায়ী মানসিক
অসুস্থতাজনিত প্রতিবন্ধিতা, ৪. দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা, ৫. বাক্প্রতিবন্ধিতা,
৬. বুদ্ধিপ্রতিবন্ধিতা, ৭. শ্রবণপ্রতিবন্ধিতা, ৮. সেরিব্রাল পালসি, ৯.
বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধিতা ও ১০. অন্যান্য প্রতিবন্ধিতা।
জাতিসংঘের শিশু
অধিকার সনদের (সিআরসি) ২৩ ধারা অনুযায়ী, অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর মতো
প্রতিবন্ধী শিশুরাও সমঅধিকার ও সমসুযোগ পাওয়ার অধিকারী। ২০০৬ সালের ১৩
ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রতিবন্ধী
ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক একটি সনদ (সিআরডিপি) গৃহীত হয়। এ সনদ ২০০৮ সালের ৩
মে থেকে কার্যকর হয়। সিআরসি ও সিআরপিডি সনদে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো
প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশু যেন কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়াই তাদের অধিকার ভোগ
করতে পারে, তা নিশ্চিত করবে। এই দুটি সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে
বাংলাদেশও রয়েছে। জাতীয় শিশু নীতিমালাতেও প্রতিবন্ধী শিশুসহ সব শিশুর
অধিকার সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা ভিন্ন।
প্রতিবন্ধীদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক। তাদের মেধার বিকাশে
যথেষ্ট উদ্যোগ নেই। প্রতিবন্ধীদের দিয়ে কিছুই হবে না—এই ভেবে তাদের
বাতিলের খাতায় ফেলে রাখা হয়। এমনকি নিজ পরিবারেও প্রতিবন্ধী শিশুরা
নিগৃহীত হয়। তাদের বোঝা মনে করা হয়। জীবনের প্রতি পদে তারা অবহেলার শিকার
হয়। জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষা নিশ্চিত
করার ব্যাপারে জোর দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১-এও
প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষাসেবা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে। তার পরও
শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী শিশুদের অংশগ্রহণ খুবই কম।
জাতীয় বাজেটে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণের জন্য যথেষ্ট বরাদ্দ থাকে না। শ্রবণ ও বাক্প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো মানসম্মত ইশারা ভাষা তৈরি হয়নি। এমনকি দেশে কতজন প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে, এ ব্যাপারে সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ১ জুন থেকে সারা দেশে শুরু হয়েছে প্রতিবন্ধী জরিপের কাজ। ‘প্রতিবন্ধী জরিপে অংশ নিন, দিনবদলের সুযোগ দিন’ স্লোগান নিয়ে শুরু হওয়া এই জরিপের কাজ আগামী আগস্ট মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি ও বাধ্যবাধকতার আলোকে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৫ সালে প্রতিবন্ধিতা-বিষয়ক জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০১ সালে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন পাস হয়। তবে ওই আইনে অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। ফলে তখনই আইনটি সংশোধনের দাবি ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে বর্তমান সরকার ২০০৯ সাল থেকেই নতুন আইন তৈরির উদ্যোগ নেয়। আইনের খসড়া তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইনটি পাস হয়নি।
জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন থেকে
পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে সরকারের পক্ষ থেকে যেসব
উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে প্রতিবন্ধীদের জন্য বিদ্যালয় স্থাপন,
দেশের প্রতিটি জেলার একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা
করে পাঠদান; প্রতিবন্ধী শিশু ও ব্যক্তিদের জন্য সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র
স্থাপন (দেশের ৬৮টি স্থানে এই সেবা ও সাহায্যকেন্দ্র রয়েছে); অটিস্টিক
শিশুদের জন্য অটিজম রিসোর্স সেন্টার স্থাপন; দরিদ্র প্রতিবন্ধী শিশুদের
মাসে ৩০০ টাকা করে ভাতা প্রদান ও যেসব প্রতিবন্ধী শিশু বিভিন্ন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করছে, তাদের উপবৃত্তি প্রদান। এ ব্যাপারে
জাতীয় প্রতিবন্ধী ফোরামের পরিচালক ডা. নাফিসুর রহমান বলেন, সরকার
প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের চেয়ে কল্যাণের কাজটি বেশি করে থাকে। সবচেয়ে বড়
সমস্যা হচ্ছে, প্রতিবন্ধীদের দেখভালের বিষয়টি কেবল সমাজকল্যাণ
মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য প্রতিটি
মন্ত্রণালয়ের নির্দিষ্ট কর্মপরিধি থাকা উচিত। তবেই তাদের সার্বিক উন্নয়ন
সম্ভব। তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণের জন্য
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তবে যে বাজেট দেওয়া
হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়। ডা. নাফিসুর রহমান আরও বলেন, ‘প্রতিবন্ধী
ব্যক্তিদের জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী ইনস্টিটিউট হওয়ার কথা রয়েছে। এটি
প্রতিষ্ঠিত হলে এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আইন পাস হলে তাদের সমস্যার
অনেকখানি সমাধান হবে বলে আমরা আশা করছি।’
প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে কয়েকটি সুপারিশঃ
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউনিসেফ) তার বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১৩ প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে কয়েকটি সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে:
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউনিসেফ) তার বিশ্ব শিশু পরিস্থিতি ২০১৩ প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধী শিশুদের উন্নয়নে কয়েকটি সুপারিশ করেছে। সুপারিশগুলো হচ্ছে:
প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সনদ ও শিশু অধিকার সনদ অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। সাধারণ মানুষ, নীতিনির্ধারক এবং শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সুরক্ষার মতো জরুরি সেবা যাঁরা দিয়ে থাকেন, তাঁদের মধ্যে প্রতিবন্ধী মানুষের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।
একীভূতকরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে, যেন পরিবেশ শিশুবান্ধব হয়। যেমন বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যসেবা, জনপরিবহন প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রবেশগম্যতা সহজ হয় এবং প্রতিবন্ধী শিশুরা যেন তাদের সহপাঠী বা সমবয়সীদের মতো অংশগ্রহণে উৎসাহিত হয়।
প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পরিবারভিত্তিক সেবা ও কমিউনিটিভিত্তিক পুনর্বাসনের বিস্তার ঘটাতে হবে এবং এসব ক্ষেত্রে সহায়তা ত্বরান্বিত করতে হবে।
পরিবারগুলোকে সহায়তা দিতে হবে, যেন তারা প্রতিবন্ধী শিশুদের জীবনযাপনের জন্য যে বাড়তি খরচ হয়, তা মেটাতে পারে এবং আয়ের হারানো সুযোগ ফিরে পেতে পারে।
প্রতিবন্ধী শিশু ও তাদের পরিবারের চাহিদা পূরণের জন্য যেসব সহায়তা এবং সেবার পরিকল্পনা করা হয়, সেগুলো মূল্যায়নে প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরীসহ তাদের পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে এর ন্যূনতম মানকে ছাড়িয়ে যেতে হবে।
সব খাতের সেবাগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে হবে, যেন প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরী এবং তাদের পরিবার যেসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়, সেগুলোকে পূর্ণমাত্রায় মোকাবিলা করা সম্ভব হয়।
প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জীবনকে প্রভাবিত করে, এমন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রতিবন্ধী শিশু ও কিশোর-কিশোরীকে শুধু সুবিধাভোগী হিসেবে নয়, বরং পরিবর্তনের প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
প্রতিবন্ধিত্ব বিষয়ে একটি বৈশ্বিক সামঞ্জস্যপূর্ণ গবেষণা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। এর মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য ও তুলনামূলক উপাত্ত পাওয়া যাবে, যা পরিকল্পনা ও সম্পদ বণ্টন সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেবে এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রতিবন্ধী শিশুদের বিষয় আরও সুস্পষ্টভাবে উপস্থাপন করবে।
সুত্রঃ প্রথম আলো, বাংলাদেশ